দলবেঁধে ধর্ষণকে রোহিঙ্গা নিধনের মূল অস্ত্র বানিয়েছে মিয়ানমার


জাতিসংঘের এক অনুসন্ধানী দল জানিয়েছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নারীরা ধারাবাহিকভাবে সে দেশের সেনাবাহিনীর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ঘটনা তদন্তে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে গিয়ে সেইসব ভয়াবহ যৌন নিপীড়নেরা ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছে সহিংসতা ও যৌন নিপীড়ন ঘটনা তদন্তে গঠিত জাতিসংঘের অনুসন্ধানী দল।
অস্ট্রেলিয়ার এবিসি নিউজ আর ভারতের এনডিটিভিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ধারাবাহিকভাবে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার কথা তুলে এনেছে।

এদিকে জাতিসংঘের দুই কর্মকর্তা বলেছেন রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে তাড়ানোর অস্ত্র হিসেবে সংঘবদ্ধ ধর্ষণকে ব্যবহার করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। মিয়ানমারের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সাম্প্রতিক মানবাধিকার হরণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা তদন্তে ওই অনুসন্ধানী দল গঠন করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনরে উদ্যোগে ওই দল তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের চলমান তদন্তকে ভিত্তি করে রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

সেই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আয়েশা (ছদ্ম নাম) নামের এক নারীর বিপন্নতার কথা। আরো অনেকের সঙ্গে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন আয়েশা। ২০ বছর বয়সী এই নারী এসেই লেডা শরণার্থী শিবিরের চিকিৎসাকেন্দ্রের শরণাপন্ন হন। তার গ্রামে যখন সেনাবাহিনী প্রবেশ করে গ্রামবাসী পালাতে শুরু করে। আয়শা এএফপিকে বলেন, সেনারা এসেই বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে থাকে। সবাই পালাচ্ছিল। কিন্তু আমাকে তো আমার সন্তানের কথা ভাবতে হবে। আয়শা এএফপিকে জানান, সেনা পোশাক পড়ে ৫ জন এসেছিল তার বাড়িতে। এদের একজন তাকে ধর্ষণ করে আর বাকীরা তা চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে।

যুদ্ধ-সংঘর্ষে যৌন সহিংসতার ব্যবহার সংক্রান্ত জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি প্রমিলা প্যাটেন এই সপ্তাহে বলেছেন, রাখাইনের নিরাপত্তা অভিযান নিয়ে তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, যৌন নিপীড়নকে সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর (রোহিঙ্গা) জীবিতদের তাড়িয়ে দেওয়ার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। সামিলার (ছদ্ম নাম) পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। ‘আমি জানি না, কোথায় আমার স্বামী-সন্তান। আমি মানুষজনের কাছে বারবার জানতে চাইছি। কোনো খবর পাচ্ছি না। দুঃখ ভারক্রান্ত মনে তিনি বলেন সামিলা।

এরপর তিনি ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে ফিরে যান বাঁশ দিয়ে বানানো আশ্রয়স্থলে। এটাই এখন তাদের বসতবাড়ি। এএফপিকে সামিলা বলেন, যখন তিনি বাংলাদেশে পালিয়ে আসছিলেন ৩দিনের পথ হেঁটে, তখনও তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছিলো। কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, সংঘবদ্ধ হয়ে তিন সেনা আমাকে ধর্ষণ করে। তারা চলে যাওয়ার পর আমি দুই সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। জীবনের তাগিদে বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে ধেয়ে আসতে থাকা মানুষের কাতারে সামিল হোই। এবিসি রেডিও’র সাংবাদিক লিয়াম কোচরেন। রাখাইনে প্রবেশের সুযোগ হয়েছিল তার।

মিয়ানমার কতৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। তা সত্ত্বেও সুকৌশলে তিনি বের করে এনেছেন সেখানকার ভয়াবহতা। রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে এবিসি-তে তিনি প্রতিবেদন করেছেন ‘রাখাইনের ভয়ঙ্কর সব ধর্ষণের গল্প বলছেন নারীরা’ শিরোনামে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ঘুরে রোহিঙ্গা নারীদের বিপন্নতা তুলে এনেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি। রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একজন সম্পন্ন মানুষ ছিলেন মোহাম্মদ কাশিম। বাড়ি ছিল, গাড়ি ছিল, ছিল একটা সুখী পরিবার। তবে হঠাৎই একদিন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তার বাড়িতে ঢুকে তছনছ করে দেয় সব।

কাশিমের চোখের সামনে তার মেয়েকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে সেনারা। সে সময় বাধা দিতে গেলে বন্দুক আর ছুরির মুখে আটকে রাখা হয় তাদের। কাশিম এনসডিটিভিকে বলেন, ধর্ষণের পর আমার মেয়েকে মেরে ফেলা হয়। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। এএফপির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নারীদের স্বামী কিংবা অন্যান্য আত্মীয়স্বজন যখন বাড়িতে থাকেন না তখনই ঢুকে পড়ে মিয়ানমারের সেনারা।

সন্তানদের সামনে ধর্ষণ করে তাদের মাকে। জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার লেডা শরণার্থী শিবিরের এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত আছেন নওরিন তাশনুপা। তিনি বলেছেন, প্রায় সব নারীকেই ধর্ষণ করা হয় পেটানোর পর। নওরিন জানান, ধর্ষিতা নারীদের থেঁতলে যাওয়া শরীর আর বুক কিংবা যৌনাঙ্গে কামড়ের চিহ্ন দেখেছেন তিনি। নওরিন এএফপিকে বলেন, মানুষ এইসব ঘটনা তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করত চান না।

গত অক্টোবর থেকে এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে। তবে আমাদের কাছে একটা অভিযোগ আসতে ৩/৪ মাসও লেগে গেছে। জাতিসংঘ অভিবাসন সংস্থার যৌন সহিংসতা থেকে সুরক্ষা সংক্রান্ত কর্মকর্তা ইরিন লরিয়া। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য এই মুহূর্তে এটি টিকে থাকার লড়াই। তার মতে ধর্ষণকে অস্ত্র বানানো হয় নানাভাবে। ইরিন জানান একসময় ধর্ষণকে ব্যবহার করা হতো নিপীড়নের একটি উপায় হিসেবে। প্রকাশ্যে নগ্ন করে হাঁটিয়ে নিয়ে বেড়ানো হতো রোহিঙ্গা নারীদের, তাদের ওপর যৌন সহিংসতা চালানো হতো। তবে ইরিনের ভাষ্য অনুযায়ী সবশেষ ধাপে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের যে আলামত পেয়েছেন, সেখানে ধর্ষণকে ব্যবহার করা হচ্ছে নারীদের বিরুদ্ধে ভীতি ছড়াতে।

সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনাগুলো বিচার করে তার মনে হয়েছে, যতো দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেওয়াই এগুলোর উদ্দেশ্য। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দলের বরাত দিয়ে এএফপি আরো জানায়, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েও এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি। যুদ্ধে যৌনসহিংসতা বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি প্রমিলা প্যাটেন জানিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সহিংসতা এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

এর আগে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রসের প্রতিনিধি কোরিন আম্লার বলেছেন, শুধুমাত্র প্রাণভয়ে যে সব রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের অবস্থা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। রোহিঙ্গাদের অবর্ণনীয় অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে ইউনিসেফের মুখপাত্র ম্যারিক্সি মারকাডো বলেন, শরণার্থীদের কষ্ট দিনকে দিন বাড়ছে। তারা অমানবিক অবস্থায় অস্থায়ী ক্যাম্পে দিন পার করছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতো প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার করে রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন।

মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাকে জাতিসংঘ ইতোমধ্যে জাতিগত নির্মূলের পাঠ্যপুস্তকীয় দৃষ্টান্ত আখ্যা দিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অক্টোবরে শুরু হওয়া সেই যৌন নিপীড়নকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কাঠামোগত সহিংসতা আখ্যা দিয়েছেন।
Share on Google Plus

About Admin

0 comments:

Post a Comment

Thanks for your comments.