নতুন ক্লাস। নতুন বই। নতুন বইয়ের পাতায় পাতায় নতুন গল্প, কবিতা আর অজানাকে জানার আগ্রহ। বছরের প্রথম দিনেই নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মাতোয়ারা প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী। সন্তানদের এই বাঁধভাঙা খুশিতে আনন্দিত অভিভাবকরাও। নতুন বছরের প্রথম দিন সারা দেশে স্কুলশিশুরা মেতেছিল নতুন বইয়ের উৎসবে।
কুয়াশার চাদরে ঘেরা গ্রাম-শহরের প্রতিটি প্রান্তরে শিশুরা নতুন বই নিতে সকাল থেকেই জড়ো হতে থাকে নিজ নিজ স্কুলের আঙিনায়। সকালের সোনারোদে শিশুদের হাসিমুখ যেন বলে দিচ্ছিল, বইয়ের প্রতি, শিক্ষার প্রতি তাদের অগাধ ভালোবাসা আর আন্তরিকতার কথাই। নতুন বই হাতে পেয়ে, বুকে জড়িয়ে তার গন্ধ শুঁকে শিশুরা নির্মল হাসিমুখে ছুটে গেছে বাড়িতে।
গতকাল সকালে রাজধানীর দুটি জায়গায় আলাদা আলাদা বই উৎসবের উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। সকাল ১০টায় আজিমপুর গভর্নমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী। একই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে বর্ণিল অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ উৎসবের উদ্বোধন করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী।
বই উৎসবের উদ্বোধন করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বছরের প্রথমদিনেই সব স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর মাঝে বই বিতরণ বিশ্বে অতুলনীয়। এ কার্যক্রম সারা পৃষ্ঠা ১৭ কলাম ৪ পৃথিবীতে প্রশংসিত হয়েছে।
২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত মোট ২৬০ কোটি ৮৫ লাখ ৯১ হাজার ২৯০টি বই বিতরণ করা হয়েছে। আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমরা বিনামূল্যে বই দিই, উপবৃত্তি দিই বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিই বলেই এখন সবাই স্কুলে যায়- এটা আমার মনে হয় না। স্বাধীনতার মর্মবাণী উপলব্ধি করতে পারে বলেই তারা স্কুলে যায়। বিগত কয়েক বছরের প্রথম দিনই বিনামূল্যে বই বিতরণ করতে পারাকে সরকারের অন্যতম বড় অর্জন হিসেবে দেখেন তিনি। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের বই উৎসব উপলক্ষে আজিমপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সাজানো হয়েছিল বর্ণিল সাজে। উৎসবের মঞ্চ ছিল লাল-সবুজে মোড়ানো। ছাত্র-ছাত্রী আর অতিথিদের ক্যাপেও ছিল জাতীয় পতাকার রঙ। হাতে পাওয়া বই তুলে ধরে উৎসবের রঙে মিশে যায় শিশুরা।
জাতীয় সংগীতের পর বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ। ২৫টি বিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয় এই উৎসবে। তার মধ্যে সাতটি বিদ্যালয়ের সাতজনের হাতে বই তুলে দেন মন্ত্রী। আজিমপুর স্কুলের শিক্ষার্থী তানজিম মোর্শেদ বলেন, নতুন বই পাওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, সারাবছর এ দিনের অপেক্ষায় থাকি। নতুন বই আমার পড়ার নতুন মজা তৈরি করে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে এসেছিল লালবাগ, মতিঝিল, কোতোয়ালি, রমনা, সূত্রাপুর ও ডেমরা থানার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় পাঁচ হাজার শিশু বই নিতে। বই হাতে পাওয়ার পর মতিঝিল মডেল স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী নায়না তাবাসসুম বুশরার আনন্দ যেন আর ধরে না।
সে বলে, আমার নতুন বই ধরতে খুব ভালো লাগছে। বাসায় গিয়ে ভাইয়াকে দেখাব। গেণ্ডারিয়া হাই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির রাজ মণ্ডল উচ্ছ্বাস প্রকাশের বদলে বই নিয়ে পরিকল্পনায় মশগুল। বাসায় গিয়ে প্রথমে নতুন বইয়ে মলাট দেবে সে। তারপর পড়ে ফেলবে বাংলা বইয়ের গল্পগুলো। প্রথমিকের এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের শিক্ষকরাও এসেছিলেন বই উৎসবে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান জানান, মাধ্যমিক স্তরের এক কোটি ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৪ শিক্ষার্থীর জন্য ১৮ কোটি ৭৩ লাখ ৮৫ হাজার ৯২১টি বই বিতরণ করা হবে। প্রাথমিক স্তরে ২ (দুই) কোটি ১৭ লাখ ২১ হাজার ১২৯ শিক্ষার্থীর জন্য ১০ কোটি ৩৬ লাখ ২৪ হাজার ৪০৫টি বই বিতরণ করা হবে। এছাড়াও প্রাক-প্রাথমিকের ৩৪ লাখ ১১ হাজার ১৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৬৮ লাখ ২৩ হাজার ৬৪৮টি বই ছাপা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৫৮ হাজার ২৫৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য পাঁচটি ভাষায় এক লাখ ৪৯ হাজার ২৭৬টি বই ছাপা হয়েছে। এ ছাড়াও ৯৬৩ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য ৮ হাজার ৪০৫টি ব্রেইল বই বিতরণ করা হবে। প্রতিবছরের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ৩০শে ডিসেম্বর এই বই বিতরণ উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন, কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর, কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার বিশ্বাস, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. মাহাবুবুর রহমান এবং পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান।
আর প্রাথমিক বই বিতরণ কমর্সূচিতে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আসিফুজ্জামান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোতাহার হোসেন, নজরুল ইসলাম বাবু, উম্মে রাজিয়া কাজল, আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর মহাপরিচালক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং জনপ্রিয় উপস্থাপক হানিফ সংকেত। এদিকে গতকাল সারা দেশের সব স্কুলে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হয়েছে। বই দেয়াকে কেন্দ্র করে স্কুলে স্কুলে ছিল শিক্ষার্থীদের উৎসব।
0 comments:
Post a Comment
Thanks for your comments.