সম্প্রতি বগুড়ার এক শিক্ষার্থীকে বাড়ি তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে পরে ধর্ষিতা ও তার মাকে অমানবিক নির্যাতন করে মাথা ন্যাড়া করার অভিযোগে বগুড়া সদর থানায় দায়ের হওয়া ২টি মামলার প্রধান আসামি তুফান সরকারকে নিয়ে দেশব্যাপী চলছে নিন্দা-ধিক্কারের ঝড়।
ঘটনাটি মিডিয়ায় প্রকাশ হবার পর দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কে এই তুফান সরকার? তার ক্ষমতার উত্স কি? মাত্র ২৪ বছর বয়সে কিভাবে এত ধন সম্পদের মালিক হলেন তিনি? এসব কিছুর অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে নানা বিস্ময়কর তথ্য। শ্রমিক লীগের রাজনীতি করে তেমন কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই কেবল চাঁদাবাজি করে কোটিপতি ও বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে গেছেন তিনি।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, বগুড়া শহরের চকসুত্রাপুর এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী মজিবর সরকারের কনিষ্ঠ ছেলে তুফান সরকার। পারিবারিকভাবেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত মজিবর পরিবার। এরই মাঝে মজিবরের ২য় সন্তান মতিন সরকার রাজনীতিতে আসেন ১৯৯৪-৯৫ এর দিকে। বগুড়া শহর যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক হন মতিন। এখনো ওই পদেই আছেন। এছাড়াও বর্তমানে বগুড়া জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি ও জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তিনি ।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরও তুফান দলীয় কোনো পদেই ছিলেন না। বড়ভাই মতিন সরকারের পরিচয় ব্যবহার করেই ছোটখাটো তদবির ও উচ্ছৃঙ্খল কাজ করে বেড়াতেন। কিন্তু তার ভাইয়ের কারণে কেউ কিছু বলতো না। এরই মাঝে তুফানের অপর এক ভাই পুটু সরকার জড়িয়ে পড়েন মাদক ব্যবসায়। অল্পদিনেই প্রচুর বিত্তবৈভবের মালিক হন পুটু। এরপর আরেক ভাই ঝুমুর সরকার একই পথে হাঁটতে শুরু করেন তুফান সরকারকে সাথে নিয়ে। তুফান সক্রিয় রাজনীতিতে আসেন ২০০৯ সালে। পেয়ে যান শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়কের পদ (বর্তমানে বহিষ্কৃত)।
মাদক ব্যবসার কারণে প্রচুর অর্থের মালিক বনে যাওয়া তুফান বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। অল্প বয়সেই নিজের ভাই যুবলীগ নেতা মতিন সরকারকে ছাপিয়ে ‘বড় নেতা’ বনে যান। চাঁদাবাজিতেও জড়িয়ে পড়েন। নিত্যনতুন গাড়ির মডেল বদলাতে শুরু করেন। অভিযোগ আছে, তুফান শ্রমিক লীগে যোগ দেবার পর বগুড়া শহর শাখার আহ্বায়ক হয়ে শহরে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার রিকশা-ভ্যান মালিক সমিতির নামে নিজস্ব বাহিনী দিয়ে চাঁদা আদায় করতেন প্রকাশ্যেই।
প্রতিটি রিকশা মালিককে সমিতিতে অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করে তাদের কাছ থেকে বাত্সরিক ‘ফি’ বাবদ ১ হাজার ৮শ টাকা করে আদায় করতেন। এতে বগুড়া শহরে চলাচলকারী প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি রিকশা-ভ্যান থেকে মাত্র ৩ বছরেই আয় করেন কয়েক কোটি টাকা। সমিতিভুক্ত প্রতিটি রিকশা-ভ্যান থেকে তার সমিতির নামে ২০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করতো নিজস্ব বাহিনী। সেখান থেকেও আয় হতো প্রতিদিন ২ লক্ষাধিক টাকা।
প্রতি বছর নবায়ন বাবদ আদায় করা হতো আরো ৮শ টাকা করে। এভাবে প্রায় ৩ বছর চলার পর চলতি বছরের শুরুর দিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বগুড়া সফরকালে অভিযোগ শুনে এই চাঁদাবাজি বন্ধের নির্দেশ দিলে তা বন্ধ হয়। কিন্তু ততদিনে তুফান কোটিপতি বনে গেছেন। সম্প্রতি তুফান নিজ এলাকায় প্রাসাদতুল্য বাড়ি নির্মাণ করেছেন। সেই বাড়িতেই ধর্ষণ করেন ঐ শিক্ষার্থীকে । পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল তুফানকে ইয়াবা ও ফেনসিডিলসহ গ্রেফতার করা হয়। পরে জামিনে বের হন।
একই বছর ২০ জুলাই একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় তুফান এবং তার তিন ভাই ঝুমুর, ওমর ও সোহাগ গ্রেফতার হন। তবে কোনো সময়ই তাদের বেশিদিন ধরে রাখা যায়নি। ফলে তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তুফান বাহিনীর বিরুদ্ধে শহরের বিভিন্ন স্থানে জায়গা-জমি ও দোকানপাট দখলের বহু অভিযোগ আছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তুফানের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেও কোনো লাভ হতো না। এবার শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলায় গ্রেফতার এবং এই ঘটনা দেশব্যাপী আলোচিত হওয়ায় পুলিশ তুফানের অপরাধ জগতের খোঁজ-খবর নিতে জোর শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে।