আশরাফ সিফাত(ছদ্ম নাম)। পড়াশুনা করছেন রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখাপড়ার খাতিরে মফস্বলে থাকা বাবা-মাকে ছেড়ে মোহাম্মদপুর এলাকার একটি মেসে থাকেন তিনি। তিন দিন আগে হুট করেই তর্ক বাধে তার রুমমেটদের সঙ্গে।
এ সময় তার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় তাকে মেরে ফেলে ব্লু হোয়েল খেলে আত্মহত্যা করেছেন বলে চালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন তার এক রুমমেট। বিষয়টি ততোটা গুরুতরভাবে না নেওয়ায় কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি তিনি। তবে কথোপকথনে ব্লু হোয়েল নিয়ে সৃষ্টি হওয়া আতঙ্কের বিষয়ে আশরাফ বলেন, ব্লু হোয়েল নিয়ে আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থা অনেকটাই এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, কেউ কাউকে মেরে ফেলে তার হাতে ট্যাটু এঁকে এই গেম খেলে আত্মহত্যা করেছেন বলে চালিয়ে দিতে পারেন।
আমাদের মধ্যেও এখন ব্লু হোয়েল গেম খেলার বিষয়টি এখন এমনভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে কাছের আত্মীয়-স্বজনও হয়ত সেটাই বিশ্বাস করবে। আশরাফের এমন ধারনা একেবারেই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কারণ গত বৃহস্পতিবার একটি অনলাইন গেম খেলে অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন ১৭ বছরের এক কিশোর। অনলাইন ভিত্তিক একটি গেমে আসক্ত হয়ে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার কথা স্বীকার করলেও ব্লু হোয়েল গেম খেলার কথা অস্বীকার করে ওই কিশোর। ওই ছাত্রের বাবার দাবি ছিল, তার ছেলে কোনো গেমেই আসক্ত ছিল না।
বাবা-ছেলের বক্তব্য পরস্পর বিরোধী হলেও কেউই স্বীকার করেননি ব্লু হোয়েলে আসক্ত হওয়ার কথা। তবুও ওই ছেলে ব্লু হোয়েল খেলেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল বলে আলোচনা ছিল সর্বত্র। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা নামের কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনায়। তার বাবা শুধুমাত্র আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, মেয়ে হয়ত ব্লু হোয়েলে আসক্ত হয়ে আত্মহত্যা করতে পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এতটাই আলোড়ন ও ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয় যে, বেশিরভাগ মানুষেরই এমন মতামত ছিল যে, গেমটি খেলেই ওই কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। অন্য কোনো কারণেও যে সে আত্মহত্যা করতে পারে সে বিষয়টি যেন কেউ বিশ্বাসই করতে চাচ্ছিলেন না। সমাজের মধ্যে এমন ধারনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে প্রভাব ফেলতে পারে বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারনা কাজ করলেও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বাংলাদেশের আইন অনেক শক্তিশালী।
এখানে কেউ অপরাধ করে সেটা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেও পাড় পাবে না। সমাজের মধ্যে এমন ধারণাকে খুবই ভয়ানক বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ এহসান হাবীব। তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজটা একটা অসুস্থ সমাজ। এই সমাজের মধ্যে আবার ব্লু হোয়ের মতো আতঙ্ক আরও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। কারণ এখন এই আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করবে।
অনেককে হত্যা করে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে ব্লু হোয়েলে আত্মহত্যা করেছেন এমন নামে।’ এহসান হাবীব বলেন, ‘সমাজের কিশোর ও তরুণ সমাজ যেমন ব্লু হোয়েলে আসক্ত তেমনি এই আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে ফায়দা নেয়ার চেষ্টাটাও তাদের মধ্যে বেশি থাকবে। অনেকেই হয়ত নিজেদের মধ্যকার প্রতিশোধ স্পৃহাকে ফলাতে চাইবেন এই গেমের মাধ্যমে। যা সমাজের জন্য খুবই নেগেটিভ ইফেক্ট বয়ে আনবে। অভিভাবকদের উচিত হবে কেউ আত্মহত্যা করলে ওই কিশোর বা তরুণের মরদেহে ব্লু হোয়েলের চিহ্ন পেলেও চোখ বুজে মৃত্যুর কারণ হিসেবে গেমে আসক্তি ধরে না নিয়ে বিষয়টির তদন্তের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের শিক্ষক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, ‘ব্লু হোয়েল নিয়ে সমাজে যে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে সেটাকে কাজে লাগিয়ে নিজের অপরাধকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন অপরাধীরা। যে ব্যক্তি অপরাধ করছেন সে হয়তো ব্লু হোয়েল না আসলেও হত্যাকাণ্ডটি ঘটাত। কিন্তু এই ট্রেন্ডকে কাজে লাগালে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগটি তার দিকে না গিয়ে ব্লু হোয়েলের দিকে যেতে পারে এমন সম্ভাবনা থেকে সে নিজের অপরাধ ঢাকতে এমন চেষ্টা চালাতে পারেন।’ তিনি আরও বলেন, আমরা সমাজে আলোচিত বিষয়টি নিয়ে সকলকে পড়ে থাকতে দেখি। যেমন একবার এক জায়গায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে অন্য জায়গাতেও এমন ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।
এখন যেহেতু সমাজে ব্লু হোয়েল ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে তাই এটার প্রতি ঝোঁক যেমন বেশি থাকবে তেমনি অপরাধীদের চেষ্টা থাকবে এই ট্রেন্ডকে চালিয়ে নিজের অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার। অপরাধীরা অপরাধ করে তা নানা উপায়েই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে মন্তব্য করে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী সিকদার বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই অপরাধীরা নিজেদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে চাপা দেয়ার জন্য নানা ফন্দি আঁটেন। হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য ফ্যান কিংবা গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখার মতো ঘটনা অনেক আগে থেকেই ঘটে আসছে।
নতুন এই ট্রেন্ডকেও অপরাধীরা তাদের অপরাধ ঢাকার জন্য ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারেন।’ তবে বাংলাদেশের আইন অনেক শক্তিশালী বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কাউকে হত্যা করে ব্লু হোয়েলে আসক্তের কারণে তিনি মারা গেছেন; এমন ফন্দি করে কোনো অপরাধী পাড় পেয়ে যেতে পারবেন এমনটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশের আইন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক শক্তিশালী। কেউ এ চেষ্টা করলেও তদন্তে সকল সত্যে বেরিয়ে আসবে।’ তবে এই ট্রেন্ডে যুক্ত হয়ে কেউ যাতে আত্মহত্যা না করেন সেজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন মোহাম্মদ আলী সিকদার।-সময় নিউজ
0 comments:
Post a Comment
Thanks for your comments.