বিপিএলে (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ) মঙ্গলবার টিটাগাং ভাইকিংসের বিপক্ষে ব্যাট করছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অপূর্ব হেয়ার স্টাইলে (সেলুন) খেলা দেখছিলেন একদল যুবক।
দ্বিতীয় ওভারে চতুর্থ বল মাঠে গড়ানোর আগে তাদের একজন- আল-আমিন বললেন, বাকি দুই বলে ১০ রান। না হলে এক হাজার। উত্তরে কায়সার বললেন, মামা আমি আছি। শেষ হলো ওভার। হেরে গেলেন আল আমিন। হেরেই পেশাদার বাজিকরের মতো টাকা তুলে দিলেন কায়সারের হাতে।
এভাবেই পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান থেকে জুয়ার এ আখড়া এখন ভার্চুয়াল জগতে। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের ফ্রাঞ্চাইজি লিগ বিপিএলে। শুধু ম্যাচে নয়, এ জুয়া এতটাই ছড়িয়েছে যে, তা গড়িয়েছে প্রতি বলে বলে। আর এ জুয়াকে কেন্দ্র করে খুনসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে যুবসমাজ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দশক ধরে দেশে যে ক্রিকেট উন্মাদনা দিন দিন বাড়ছে। এ উন্মাদনাকে এক শ্রেণীর জুয়াড়ি তাদের সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। প্রথমদিকে জুয়াড়িরা শহরকেন্দ্রিক তৎপরতা শুরু করলেও এখন তা ছড়িয়ে দিচ্ছে গ্রামে। অনেকটা প্রকাশ্যেই চলছে এ জুয়ার আসর। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা তেমন চোখে পড়ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার চিটাগাং ভাইকিংসের বিপক্ষে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের ম্যাচ ঘিরে বাজি হয়েছে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা। এ হিসাব শুধু অনলাইনভিত্তিক একটি বেটিং সাইটের। একটি ওয়েব সাইটের যখন এ অবস্থা তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অগণিত যেসব ওয়েবসাইটে এ জুয়া চলছে, তার অঙ্কটা বলা মুশকিলই। বিপিএলের কারণে এ সাইটগুলোতে বিদেশিদের পাশাপাশি দেশীয় বাজিকরদের আনাগোনাও বেড়েছে। গত বছর ১২টি দেশীয় গ্যাম্বলিং সাইট বন্ধ করেছে বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন) । তবে থেমে নেই জুয়াড়িরা। ভিন্ন ভিন্ন নতুন সাইট খুলে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের অপকর্ম।
সূত্রমতে, মূলত বাজিকরেরা দু’পক্ষকে এক করে দিতে এজেন্ট হিসেবে কাজ করে ‘বেট ফেয়ারের’ মতো এই সাইটগুলো। কোনো একটি ম্যাচকে নির্দিষ্ট দর দিয়ে দেয়া, পরে দুপক্ষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিজয়ীকে লাভসহ ফিরিয়ে দেয়াই তাদের কাজ। ম্যাচ শেষে জয়ী বাজিকরের কাছ থেকে ৬ থেকে ৫ শতাংশ টাকা কেটে নেয়া হচ্ছে চার্জ হিসেবে। আর সে হিসেবে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তাদের আয় ছিল প্রায় ৪শ’ মিলিয়ন ডলার। প্রচলিত আইন মেনেই এ জুয়ার ব্যবসা করে যাচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার বলেন, বিপিএলে ওয়ার্ল্ড ক্লাস ক্রিকেট হচ্ছে। তাদের খেলা দেখে এনজয় করা যায়। ক্রিকেট এনজয়ের জন্য জুয়া খেলার প্রয়োজন নেই। আমি আশা করি, কোনো যুবক আর এ ভুল করবে না। এটা শুধু খেলা। আমরা ভালো খেলা দেখতে চাই। আর যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, যুব সমাজের প্রতি এমন আহ্বান জানান তিনি।
ক্রিকেট দলের পেসার তাসকিন আহমেদ বলেন, শুনেছি, ক্রিকেট নিয়ে ব্যাটিং হচ্ছে। ক্রিকেট দেশকে অনেক উপরে নিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়াও ইসলামে জুয়া নিষিদ্ধ। দেশের যুবসমাজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি আরও বলেন, আপনারা যদি জুয়া বন্ধ না করেন, তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।
বিপিএলের গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আফজালুর রহমান বলেন, ‘আমি সকালে পত্রিকায় বাড্ডার (হত্যাকাণ্ড) ঘটনাটা দেখে খুবই মর্মাহত হয়েছি। আমরা এত কিছু জানতাম না। খেলার আয়োজকেরা স্টেডিয়ামের ভেতরে কিছু হলে সেটার বিষয়ে বলতে পারে। কিন্তু স্টেডিয়ামের বাইরে পাড়া-মহল্লায় এ ধরনের কিছু হলে তো সেটা ঠেকানো সাধ্যের বাইরে।’
এ বিষয়ে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নাজমুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণীর জুয়াড়ি সুযোগ নিচ্ছে। ভার্চুয়াল জগতে চলতে জুয়ার রমরমা ব্যবসা। বিভিন্ন ওয়েবসাইট খুলে জুয়া খেলা হচ্ছে। এসব জুয়া খেলার ওয়েবসাইট খুঁজে বের করে সেগুলো বন্ধের কাজ করা হচ্ছে।
ক্রিকেট নিয়ে জুয়া নতুন নয়। ২০১৪ সালে ঢাকায় ধরা পড়েছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জুয়াড়ি অতনু দত্ত। তাকে গ্রেফতারের পর র্যাবব জানতে পারে, ওই জুয়ার সঙ্গে আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ও নিরাপত্তা ইউনিটের কর্মকর্তা ধরম সিং যাদব জড়িত। রাজশাহীতে এ বছরের ২২ সেপ্টেম্বর ক্রিকেট জুয়া নিয়ে বিরোধে নিহত হন এক যুবক। এর আগে জুয়াড়িদের সঙ্গে নিয়ে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগে জাতীয় দলের খেলোয়াড় আশরাফুল ইসলামসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
সর্বশেষ গত রোববার পূর্ব বাড্ডায় বিপিএলের জুয়ার আসর বসতে না দেয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের পরে ঢাকার পুলিশ ক্রিকেট নিয়ে জুয়ার বিষয়ে তৎপর হলেও পরিস্থিতি তেমন বদলায়নি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘বাড্ডার ঘটনার পরে আমরা সব গোয়েন্দা সংস্থাকে বলেছি, এ ধরনের জুয়া বন্ধ করতে ও নজরদারি বাড়াতে। সব থানা-পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
জুয়া খেলে ছেলে, সর্বস্বান্ত বাবা : মঙ্গলবার বিকালে মোহাম্মদপুরে ছোট ছোট চায়ের দোকানগুলোতেও চলেছে জমজমাট জুয়া। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি রেস্তোরাঁর কর্মী, বইয়ের দোকানের বিক্রয়কর্মী, মোটর গ্যারেজের মেকানিক, প্রেসের কর্মী সবাই এসে জুটেছেন এখানে। এরা অধিকাংশই নিম্ন আয়ের, বেশির ভাগের বয়সই কম। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান বলেন, আমার বন্ধু মতিউর রহমান কয়েক দিনে প্রায় ৫ হাজার টাকা বাজিতে হেরেছে। এ টাকা তার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার ফ্রির জন্য পাঠিয়েছিলেন।
যেভাবে চলছে প্রকাশ্যে জুয়া : দলের হার-জিত, পরের বলে কত রান বা ছয়-চার হবে কি না, পরের ওভারে ব্যাটসম্যান আউট হবেন কি না, একজন বোলার কত উইকেট পাবেন, ব্যাটসম্যান কত রান করবেন, দলের কত রান হতে পারে, নির্দিষ্ট দল কত রান বা উইকেটের ব্যবধানে জিতবে ইত্যাদি ছোটখাটো নানা বিষয় নিয়েই চলছে প্রকাশ্য বাজি ধরা। বাজির দরও ঠিক করেন নিজেরাই।
মোহাম্মদপুর এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ী এলাকার চায়ের দোকান, সেলুনগুলোতে বিপিএল ঘিরে প্রতিদিনই বসছে জুয়ার আসর। আশপাশের মেসে থাকা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ জুয়ায় যোগ দিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. জিহাদ বলেন, আমার অনেক বন্ধু ক্রিকেট জুয়ায় মজেছে। নিজেদের মেসে বা পাড়ার চায়ের দোকানে প্রতিদিনই বসছে এ রকম জুয়ার আসর। দু-একজন মাঝেমধ্যে কিছু পয়সা জিতলেও শেষ পর্যন্ত সবাই হারছেন। গত শনিবার জুয়ায় হেরে আমার পাশের রুমের এক বন্ধু হাতের ঘড়ি বেচতে বাধ্য হয়েছে।
ঢাকার বাইরেও একই অবস্থা : চট্টগ্রামের এক তরুণ বলেন, ক্রিকেট জুয়ায় যুবসমাজ এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে যে, খেলা চলছে ঢাকায়, আর বলে বলে বাজি চলছে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামে বিপিএলের সময় নগরের প্রতিটি মোড়ের চা-দোকানে পাড়ায় পাড়ায় বাজি ধরা হয়। তবে এর মধ্যেই নগরে বেশ কয়েকটি মারামারি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে।
রংপুর শহরের বিভিন্ন জায়গাতেই চলছে বাজি ধরা। বিশেষ করে কাচারিবাজার এলাকার সেলুনগুলোতে খেলা দেখার সঙ্গে সঙ্গে চলে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো ভিড় করে বাজি ধরে। হারাগাছের বিড়িশিল্প এলাকায় অনেক বিড়ি শ্রমিককেই এ বাজি ধরতে দেখা গেছে। তাদের অনেকেই দিনের উপার্জন নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন না।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, খেলাধুলা মানুষকে নির্মল আনন্দ দেয়। কিন্তু যদি ক্রিকেট খেলার প্রতিটি বল বাজি ধরার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সে খেলার আনন্দ মাটি হয়ে যায়। জুয়ায় যুবসমাজ ধ্বংস হলে খেলার কী মূল্য থাকে। আর এ ধরনের জুয়া সামাজিক শান্তি নষ্টেরও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। খুনোখুনি হচ্ছে। এ থেকে বড় কোনো সর্বনাশ হওয়ার আগেই আমাদের সাবধান হতে হবে। কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
0 comments:
Post a Comment
Thanks for your comments.