উত্তরের শষ্যভান্ডার ধানের জেলা দিনাজপুরে ‘মিনিকেট’ চালের নামে প্রতারণা চলছে। এ চাল খেয়ে মরণব্যাধি ক্যানসারসহ মানব দেহে অক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন রোগ-বালাই। এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলায় এক অটোরাইস মিল ব্যবসায়ী এই ‘মিনিকেট’ চাল বিক্রি করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ওই ব্যবসায়ী অটোরাইস মিল বসিয়ে বর্জ ফেলে এলাকার পরিবেশ দূষণ করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মজুদ বন্ধ করতে আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের ৩০ অক্টোবরের মধ্যে লাইসেন্স করতে নির্দেশ দিয়েছিলো খাদ্য অধিদপ্তর। অথচ সেই সময় পেরিয়ে গেলেও দিনাজপুরের বেশির ভাগ আমদানীকারকরা লাইসেন্স গ্রহণ করেননি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘মিনিকেট’ নামে ধানের কোনো জাত নেই। বাংলাদেশ কিংবা ভারত-কোনো দেশেই মিনিকেট নামে ধানের কোনো জাতের অতিত্ব মিলেনি এখনো। মূলতঃ একশ্রেণির চালকল মালিক ভোক্তাদেরকে বোকা বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মোটা চাল ছেঁটে সরু করে তা মিনিকেট নামে চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মোটা চাল মেশিনে চিকন করা হয়। তার নাম হয় মিনিকেট। এই চালের পুষ্টিগুণ কমে যায়। কাটিং, পলিশ ও কালার ঠিক রাখার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন কেমিক্যাল যা মানব দেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। বিষয়টি চরম উদ্বেগের। শুধু মুনাফার লোভেই ব্যবসায়ীরা দেশবাসীর প্রধান খাদ্যপণ্যের এই হাল করছে। মানুষ না জেনে সেগুলোকে উৎকর্ষ ভেবে বেশি দামে কিনছে এবং খাচ্ছে।
‘১৯৯৫ সালের দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভারতের কৃষকদের মাঝে সে দেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নতুন জাতের চিকন শতাব্দী ধান বীজ বিতরণ করে। মাঠপর্যায়ে চাষের জন্য কৃষকদেরকে এ ধান বীজের সঙ্গে আরো কিছু কৃষি উপকরণসহ একটি মিনিপ্যাকেট প্রদান করে ভারতীয় সরকার’।
যে প্যাকেটটাকে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বলতো ‘মিনি কিটস’ সেখান থেকেই সেই ধানের নাম হয়ে যায় ‘মিনিকেট’। আবার অনেকে বলেন ‘মিনিপ্যাকেটে করে দেয়ায় ভারতীয় কৃষকদের কাছে এ ধান শেষমেষ মিনিকিট বলে পরিচিতি লাভ করে। কৃষকরা মিনিপ্যাকেট শব্দটির মধ্য থেকে ‘প্যা’ অক্ষরটি বাদ দিয়ে মিনিকেট বলে পরিচয় দিতে শুরু করে’। তবে ঘটনা যাই হোক মিনিকেট নামে কোনো চাল বাজারে নেই এটাই সত্য কথা। মোটা চালকে পলিশ করে মিনিকেট চাল বলে বিক্রি করা হচ্ছে।
অটোরাইস মিলে রয়েছে একটি অতি বেগুনি রশ্মির ডিজিটাল সেন্সর প্ল্যান্ট। এর মধ্য দিয়ে যেকোনো ধান বা চাল পার হলে সেটি থেকে প্রথমে কালো, ময়লা ও পাথর সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর মোটা ধান চলে যায় অটোমিলের বয়লার ইউনিটে। সেখানে পর্যায়ক্রমে ৫টি ধাপ পার হবার পর লাল কিংবা মোটা চাল সাদা রংয়ের আকার ধারণ করে। এরপর আসে পলিশিং মেশিংয়ে। অতি সুক্ষ্ম এই মেশিনে মোটা চালের চারপাশ কেটে চালটিকে চিকন আকার দেয়া হয়। এরপর সেটি আবারও পলিশ ও স্টিম দিয়ে চকচকে শক্ত আকার দেয়া হয়। শেষে সেটি হয়ে যায় সেই কথিত এবং আকর্ষণীয় মিনিকেট চাল। আর চকচকে করার জন্য দেয়া হয় বিভিন্ন ক্যামিকেল যা মানব দেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে,‘মিনিকেট’ নামে বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত কোনো জাতের ধান নেই। বিআর ২৮, কল্যানী, স্বর্ণা, গুটিস্বর্ণা, লাল স্বর্ণা আইঅর-৫০, জাম্বু ও কাজল লতা জাতের ধান ছেঁটে মিনিকেট বলে বাস্তায় ভরে বিক্রি করা হচ্ছে। বাজারে এ চালের ব্যাপক চাহিদার জন্য এ ‘মিনিকেট’ নামে প্রতারণার ব্যবসা চলছে জমজমাট ভাবে। এতে আখের গুছিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেণি’র অসৎ ব্যবসায়ী।
তবে দিনাজপুর চালকল মালিক গ্রুপের সভাপতি মোছাদ্দেক হুসেন বলেছে, মিনি কেট চাল রয়েছে। এ ধান কুষ্টিয়া অঞ্চলে চাষ হয়। মোটা চাল ছেঁটে সরু করে তা মিনিকেট নামে চালিয়ে যাচ্ছে এ অভিযোগ সত্য নয়। সাধারণ মোটা চাল মেশিনে চিকন করা হয় না। কাটিং, পলিশ ও কালার মেশানার অভিযোও সত্য নয।
এদিকে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মজুদ বন্ধ করতে আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের ৩০ অক্টোবরের মধ্যে লাইসেন্স করতে নির্দেশ দিয়েছিলো খাদ্য অধিদপ্তর। অথচ সেই সময় পেরিয়ে গেলেও দিনাজপুরের বেশির ভাগ আমদানীকারকরা লাইসেন্স গ্রহণ করেননি। জেলায় এ যাবত গুটি কয়েকজন চাল ব্যবসায়ীর লাইসেন্স হলেও বেশির ভাগ আমদানিকারকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর মধ্যে খুচরা ব্যবসায়ীরা,পাইকারী ব্যবসায়ী এবং আমদানীকারক রয়েছে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তরের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বলেছেন, এত চেষ্টার পরেও ব্যবসায়ীরা লাইসেন্স না নিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গত ২ অক্টোবর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে খাদ্য মন্ত্রী কামরুল ইসলাম চালের আমদানীকারক, মজুতদার,আড়তদারসহ সকল ব্যবসায়ীকে নতুন করে লাইসেন্স নেওয়ার নির্দেশ দেন। এ ছাড়াও ১৫ দিন পরপর গুদাম ও স্টকের চাল, গমের হিসাব স্থানীয় খাদ্য অধিদপ্তরকে অবহিত করার জন্য বলা হয়। চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত লাইসেন্স করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
এছাড়া নিয়মানুযায়ী ধান, চাল, সয়াবিন, পামওয়েল, ডাল ও চিনি এই সাতটি পণ্যের সকল ধরণের ব্যসায়ীকে ফুড লাইসেন্স করতে হবে।
মিনিকেট চাল কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। যে চাল মিনিকেট হিসেবে বিক্রি হচ্ছে সেগুলো আসলে পলিশিং মেশিনে কাটা মোটা চাল। এই চালে স্বাভাবিক খাদ্যমান নেই বলে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)। স্বাভাবিক খাদ্যমানহীন এই চাল বাজারজাত বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
রোববার বিকালে জাতীয় সংসদ ভবনে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।বৈঠক
শেষে কমিটি সদস্য মহিবুর রহমান মানিক বলেন, বিক্রেতারা ক্রেতাদের চরমভাবে ঠকাচ্ছে। বাজারে আসলে মিনিকেট বলতে কোনো চাল নেই। সবই মেশিনে কাটা পলিশিং করা চাল। এতে চালের আবরণ নষ্ট হচ্ছে, মানুষ পুষ্টিগুণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই এই চাল বন্ধে কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়কে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের চালের মিল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণায় উঠে এসেছে মিনিকেট নামে যে চাল বিক্রি হচ্ছে তা সম্পূর্ণই ভিত্তিহীন। মিনিকেট নামে কোনো চাল নেই, মোটা চাল পলিশিং মেশিনে কেটে আবরণ তুলে সাদা করা হচ্ছে। এতে খাদ্যগুণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ফলে মানুষ ভাত থেকে যে পুষ্টিগুণ পাওয়ার কথা, সেই পুষ্টিগুণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একইভাবে চড়া দামে বিক্রি করে ক্রেতাদের ঠকাচ্ছে বিক্রেতারা। অতি মুনাফা লাভের জন্যই এটি করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে গবেষণায়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০০৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১০৭টি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে, এর মধ্যে ৪৪ দশমিক ১৭ শতাংশ সরকারের অর্থায়নে, ৫২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেসরকারি অর্থায়নে এবং ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ নিজস্ব অর্থায়নে শেষ করা হয়েছে।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে যে কোনো প্রকল্প নেয়ার আগে যথেষ্ট গবেষণা করে বাস্তবভিত্তিক এবং দেশের কল্যাণের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পরামর্শ দেয়া হয়। একই সঙ্গে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ লুটপাটের ঘটনা কিভাবে রোধ করা যায় এবং শেয়ার বাজার যাতে স্থিতিশীল থাকে সে সম্পর্কে আরও কার্যকর গবেষণা পরিচালনা করার সুপারিশ করা হয়।
কমিটি সভাপতি আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে কমিটির সদস্য পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, মেজর (অব.) রফিকুর ইসলাম, মুহিবুর রহমান মানিক, তাজুল ইসলাম বৈঠকে অংশ নেন। কমিটির বিশেষ আমন্ত্রণে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন।
পরিকল্পনা বিভাগের সচিব, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব, বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিবসহ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
দেশে-বিদেশে ‘মিনিকেট’ নামের কোনো ধান নেই। বাজারে এ নামে রং-বেরঙের নানা বস্তাবন্দি যে চাল পাওয়া যায় তা আসলে সাধারণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিম্নমানের মোটা চাল মেশিনে ছেঁটে সরু করা। আর বিষয়টি এবার প্রমাণ হয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষণায়।
বিআইডিএসের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশি দামে বিক্রি করে বাড়তি মুনাফা লাভের লক্ষ্যে বিশেষ পলিশিং মেশিনে মোটা চাল কেটে চিকন ও চকচকে করা হয়। সুস্বাদু ও অতিরিক্ত চকচকে করতে এই চালে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানোরও প্রমাণ পাওয়া গেছে। মোটা চাল ছেঁটে সরু এবং রাসায়নিকের মাধ্যমে চকচকে করায় কথিত ‘মিনিকেট’ চালে স্বাভাবিক খাদ্যমান ও পুষ্টিগুণও থাকে না।
‘মিনিকেট’ চাল নিয়ে বিআইডিএসের গবেষণার এই ফলাফল রবিবার তুলে ধরা হয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে গবেষণালব্ধ ফলাফলটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করে জনসচেতনতা সৃষ্টির পরামর্শ দিয়েছে সংসদীয় কমিটি।
এ ব্যাপারে বৈঠকে সভাপতিত্বকারী পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, মোটা চাল মেশিনে কেটে চিকন করে মিনিকেট নামে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। বাস্তবে এই নামে কোনো ধান বা চাল নেই। পরিষ্কার ও চিকন হওয়ায় মানুষ এই চালের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বেশি দামে কিনছে। এতে একদিকে মানুষের খরচ হচ্ছে বেশি, অন্যদিকে কেটে চিকন করায় ও রাসায়নিক মেশানোর কারণে এই চালের পুষ্টিগুণও নষ্ট হয়ে যায়। দেশের মানুষ যেন এই প্রতারণার হাত থেকে রেহাই পায় সেজন্য কমিটি এ ব্যাপারে ব্যাপক ভিত্তিতে প্রচারণা চালানোর সুপারিশ করেছে।’
কমিটি সভাপতি জানান, ‘মিনিকেট’ চাল নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কথা ওঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করার জন্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকেও নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘মিনিকেট নিয়ে প্রচারণার উদ্যোগ নিতে বৈঠকে উপস্থিত কমিটির সদস্য পরিকল্পনা মন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামালকে (লোটাস কামাল) অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া সংসদ ভবনে কৃষিমন্ত্রীর দেখা পেয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকেও বিষয়টি জানিয়েছি।’
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিআইডিএসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- কতিপয় অতিরিক্ত মুনাফালোভী অটো রাইস মিল মালিক আধুনিক মেশিনে মোটা চাল ছেঁটে চিকন ও চকচকে করে মিনিকেট নামে বাজারে চড়া দামে বিক্রি করছে। এসব অটো রাইস মিলে রয়েছে অতি বেগুনিরশ্মির ডিজিটাল সেন্সর প্লান্ট। এর মধ্য দিয়ে ধান পার হওয়ার সময় প্রথমে কালো-মরা ধান ও পাথর সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর ওই মোটা ধান চলে যায় অটো মিলের বয়লার ইউনিটে। সেখানে পর্যায়ক্রমে পাঁচ বা একাধিক ধাপ পার হওয়ার পর লাল বা মোটা চাল সাদা রং ধারণ করে। এরপর অতি সূক্ষ্ম পলিশিং মেশিনে মোটা চালের চারপাশ কেটে চিকন করা হয়। পরে সেটিকে আবার পলিশ ও স্টিম দিয়ে চকচকে শক্ত আকার দেয়া হয়। অতিরিক্ত চকচকে ও সুদৃশ্য করতে কেউ কেউ সেটিতে ক্ষতিকর রাসায়নিকও মিশিয়ে থাকেন। এসব প্রক্রিয়া শেষে নানা নামে ‘মিনিকেট’ হিসেবে সেটি বাজারে ছাড়া হচ্ছে।
বিআইডিএসের গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি ফসলের গবেষণার ক্ষেত্রে মিনি কিট করা হতো। এ শব্দটিকে ধান বা চাল ব্যবসায়ীরা মিনিকেট করে নিয়েছে। এক শ্রেণির মিল মালিক মাঝারি সরু বি আর-২৮, বিআর-২৯ ও বি আর-৩৯ জাতের এমনকি মোটা ধান ছেঁটে মিনিকেট বলে বাজারজাত শুরু করে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোথাও মিনিকেট নামে চাল নেই। বর্তমানে বাজারে এ নামে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে তাতে ভিটামিন ডিসহ মানব শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির উপাদানগুলো নেই।
মিনিকেট ধানের চালের ভাতের প্রতি সবারই আগ্রহ রয়েছে। অথচ এ নামে ধানের কোনো জাত নেই। এক শ্রেণীর চালকল মালিক ভোক্তাদেরকে বোকা বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মোটা চাল ছেঁটে সরুকরে তা মিনিকেট নামে চালিয়ে যাচ্ছে।
কৃষিবিদ আব্দুল মজিদ বলেন, “দেশের নানা অঞ্চলে ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট উদ্ভাবিত জাতগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার ভারতীয় জাতের ধান চাষ হয়। কিন্তু মিনিকেট নামে ধানের কোনো জাত দু’দেশের কোথাও নেই। এ নামটি একটি গুজব।”
মিনিকেট নামের উৎপত্তি নিয়ে কৃষিবিদ খোন্দকার সিরাজুল করিম বলেন, “১৯৯৫ সালের দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভারতের কৃষকদের মাঝে সে দেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নতুন জাতের চিকন শতাব্দী ধানবীজ বিতরণ করে। মাঠপর্যায়ে চাষের জন্য কৃষকদেরকে এ ধানবীজের সঙ্গে আরো কিছু কৃষি উপকরণসহ একটি মিনিপ্যাকেট প্রদান করে ভারতীয় সরকার।”
তিনি আরো বলেন, “মিনিপ্যাকেটে করে দেয়ায় ভারতীয় কৃষকদের কাছে এ ধান শেষমেষ মিনিকিট বলে পরিচিতি লাভ করে। কৃষকরা মিনিপ্যাকেট শব্দটির মধ্য থেকে ‘প্যা’ অক্ষরটি বাদ দিয়ে মিনিকেট বলে পরিচয় দিতে শুরু করে।”
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বোরো মৌসুমে চাষযোগ্য এ ধানবীজ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের কৃষকদের হাতে পৌঁছায়। ঝিনাইদহ জেলার সীমান্তবর্তী মহেশপুর উপজেলার চাষিরা সর্বপ্রথম এ ধানবীজ চাষ শুরু করে। দেশে আগে নাজির শাইল, পাজাম ও বালাম ধানের চাষ হতো। এসব দেশি সরু ধানের চালের ব্যাপক চাহিদা ছিল।
সূত্র আরো জানায়, বরিশালে বালামের সুনাম ছিল সারা ভারত উপমহাদেশ জুড়ে। কালের বিবর্তনে পসসব সরু জাতের ধানচাষ উঠে যায়। তবে সরু চালের সন্ধান করতে থাকে ক্রেতারা। এসময় বাজারে কথিত মিনিকেটের আর্বিভাব ঘটে। ক্রেতারা লুফে নেয় এ সরু জাতের চাল। সুযোগ বুঝে একশ্রেণির মিলমালিক মাঝারি সরু বি আর- ২৮, বিআর- ২৯ ও বি আর-৩৯ জাতের ধান ছেঁটে মিনিকেট বলে বাজারজাত করতে শুরু করে। বর্তমানে সারাদেশে চিকন চাল বলতে এখন মিনিকেটই বোঝায়, যার দামও চড়া।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মাগুরা, যশোর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা ও চুয়াডাঙ্গায় কথিত মিনিকেট ধানের চাষ হয়। গত বোরো মৌসুমে যশোর জেলায় ৩০ হাজার হেক্টরে, ঝিনাইদহ জেলায় ১৮ হাজার হেক্টরে, চুয়াডাঙ্গা জেলায় তিন হাজার হেক্টরে ও মাগুরা জেলায় এক হাজার হেক্টর কথিত এ মিনিকেট ধানের চাষ হয়। সর্বমোট এ অঞ্চলে ৫৫ হাজার হাজারহেক্টরে মিনিকেট চাষ হয়েছিল। হেক্টর প্রতি গড় ফলন ছিল ৩ দশমিক ৬২ মেট্রিক টন।
বাজারের চালকল ব্যাবসায়ীরা জানায়, যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা ও মাগুরা জেলা ছাড়া অন্য কোনো জেলায় মিনিকেট ধান উৎপাদন হয় না। গত বোরো মৌসুমে ধান ওঠার পর প্রতিমণ মিনিকেট ধানের দাম ছিল সাড়ে সাতশ থেকে আটশ টাকা। আর সে সময় প্রতিকেজি মিনিকেট চাল পাইকারি ৩৪-৩৫ টাকা দরে বিক্রি হয়। একশ্রেণির চালকল মালিক বিআর-২৯ ও বিআর-৩৯ জাতের চাল ফিনিশিং করে মিনিকেট বলে বাজারজাত করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়ার খাজানগর, পাবনা, নওগাঁ প্রভৃতি স্থানের চালকল থেকে সারাদেশে কথিত মিনিকেট চালের সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, লাখ লাখ মন এই মিনিকেট চালের যোগান কোথা থেকে আসছে। গত বছর যে ধান উৎপাদন হয়েছে তাতে এক লাখ ৩২ হাজার মেট্রিকটন চাল হওয়ার কথা।
আড়তদাররা জানায়, অটো রাইচমিল মালিকরা কথিত মিনিকেট বলে যে চাল সরবরাহ করছে তারাও মিনিকেট বলে তাই বাজারে বিক্রি করছেন। তবে এ নামে সরকার অনুমোদিত কোনো জাতের ধান নেই। বিআর ২৮, কল্যানী, রত্না, বেড়ে রত্না, স্বর্ণা, গুটি স্বর্ণা, লাল স্বর্ণা আইআর ৫০, জাম্বু ও কাজললতা জাতের ধান ছেঁটে মিনিকেট বলে বিক্রি করা হচ্ছে।
কৃষি বিভাগের সাবেক কর্মকর্তারা বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে সুপার ফাস্ট নামে বোরো মৌসুমে চাষের জন্য ভারতের ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট একটি সরু জাতের ধান অবমুক্ত করে। এ ধানের চাল একশ্রেণির মিলমালিক সুপার মিনিকেট বলে এখন বাজারে বিক্রি করছে। এ চাল কথিত মিনিকেটের চেয়ে আরো বেশি চিকন।’
তিনি আরো বলেন, ‘দেশব্যাপী মিনিকেট চালের নামে যে চালবাজি চলছে তা কেবল ক্রেতাদের মাঝে সচেতনা বাড়লেই নিরসন সম্ভব।”
কৃষিবিদ ড. মো. শমসের আলী বলেন, “মিনিকেট নামে কোনো জাতের ধান বাংলাদেশে নেই। এটি প্রতারণা। এ প্রতারণার হাত থেকে বাঁচতে হলে সচেতনতার পাশাপাশি আমাদের সৎ হতে হবে। চাল ব্যবসায়ীরা আসল পরিচয়ে চাল বিক্রি করলে ক্রেতারা প্রতারিত হবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের চাল বাজারগুলো ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে তারা ইচ্ছা মতো চালের নাম দিয়ে বাজারে বিক্রি করছে।’
0 comments:
Post a Comment
Thanks for your comments.