কামনা জাগে কেন?


এ অধ্যায়টি কিছু দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। নরনারীর মধ্যে মিলনের আকাঙ্ক্ষা কোথা থেকে কেমন করে জম্মায় তারই বৈজ্ঞানিক ব্যাক্ষ্যা ।

এ সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলেই আগে পরিচয় দিতে হবে আমাদের শরীরস্থ জটিল রাসায়নিক গুণসম্পন্ন কতককগুলি অভ্যন্তরীণ রসের সম্বন্ধে। এই অভ্যন্তরীণ রসগুলির কথা আগে যারা কিছু না শুনছে তাদের হয়তো প্রথমে কিছু গোলমাল ঠেকতে পারে। ব্যাপরটা সোজা কথায় সংক্ষেপে বলতে চেষ্টা করি। আমাদের শরীরের মধ্যে ছোট বড় নানা আকারের বিচির মতো কতকগুলি জিনিস আছে, তার নাম গ্ল্যান্ড। গ্ল্যান্ড মাত্রেই কিছু রসের ক্ষরণ করে। এই হলো তার কাজ। এগুলিকে এক এক অদ্ভুত রকমের রসের যোগান দেবার ভিয়েনঘর বলা যেতে পারে। তবে এ রসের মধ্যে কোন মিষ্টতা নেই, আছে শুধু বিচিত্র রাসায়নিক দ্রব্যগুণ । এই আশ্চর্য গ্ল্যান্ডগুলির রস সমস্ত রক্তশিরা গুলির ভিতর দিয়ে সঞ্চারিত হয়, আর তার প্রত্যেকটির বিশেষ দ্রব্যগুণই আপন আপন কেইয়ার দ্বারা মানুষের দেহের ও মনের বিভিন্ন প্রকারের বৈচিত্র্য করে দেয়। শুধু তাই নয়, মানুষের চরিত্রেরও গঠন করে দেয়েই রসের দ্রব্যগুণ। যার শরীরে যেমন অভ্যন্তরীণ রসের প্রভাব, সে তেমন ধরনের মানুষ হতে অনেকটা বাধ্যই হয়। কথাটা তবুও হয়তো ভালো করে বোঝানো গেল না। এবার অন্য দিক দিয়ে বলি। আমরা এটা বরাবরই দেখে আসছি যে প্রত্যেক মানুষ যেন এক এক স্বতন্ত্র রকমের। সেই জন্যই আমরা অতি সহজে রামকে ঠিক রাম বলেই চিনতে পারি, আর শ্যামকে চিনতে পারি শ্যাম বলে। রাম যে কখনো শ্যাম হতে পারে না, এ আমরা একটু দেখেই বুঝে নিতে পারি। তার কারণ রামের চেহারও আলাদা, তার কথাবার্তাও আলাদা, তার ধরণধারণও আলাদা। অথচ হয় কেমন করে? সে হয় ঐ গ্ল্যান্ড গুলির অভ্যন্তরীণ রসের দ্বারা। ঐ রসই পরস্পরের ব্যাক্তিগত পার্থক্যের জন্য দায়ী। গ্ল্যান্ডের প্রভাবেই মানুষ সকল দিক দিয়ে বিভিন্ন রূপ নেয়। শুধু তাই নয়। যে যেমন জাতের মানুষ তার উপযোগী গ্ল্যান্ডগুলি আপন রসের দ্বারা তাকে পুরোপুরি ঠিক সেই জাতেরই তৈরি করে তুলেছে। অর্থাৎ পুরুষের গ্ল্যান্ড হয় পুরুষের উপযোগী, আর মেয়েদের গ্ল্যান্ড হয় তাদেরই উপযোগী। এগুলোই নারী পুরুষের মধ্যে সুনির্দিষ্ট প্রভেদ রচনা করে।

পুরুষের গ্ল্যান্ড তার আপন রসের ক্রিয়াতে মানুষটিকে গোঁপে দাড়িতে চলনে বলনে স্বতন্ত্র রসের ক্রিয়াতে তাকে দীর্ঘকেশী গুস্ফবিহীন নরম প্রকৃতি নারীর মতোই বানায়। কে পুরুষ আর কে স্ত্রী, এটুকু আমরা তাই ছেলে মেয়েদের মুখের ভাব আচরণ দেখেও বুঝতে পারি। তারা আপন আচরণের দ্বারাই নিজেদের বিশিষ্টতা প্রকাশ করে। কেউ কি শিশুকাল থেকে সেটা শিখিয়ে দেয়? তা নয়, বিভিন্ন গ্ল্যান্ডগুলি গোড়া থেকেই তাদের মধ্যে এমনি বৈচিত্র্য ঘটায়। শরীরের মধ্যে নানা রকমের গ্ল্যান্ড আর তার নানা গুণযুক্ত রস। তার মধ্যে কতকগুলি হলো বহির্মুখী, আর কতকগুলি অন্তর্মুখী। অর্থাৎ কতকগুলির রস বাইরে বেইর‍্যে এসে আপন ক্রিয়া করে, সেটা সহজেই জানা যায়। আর কতকগুলির রস গ্ল্যান্ডের তলে তলে তৈরি হয়ে খুব সূক্ষ্ম পরিমাণে সেখানেই রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। রক্তের ভিতর দিয়ে শরীরের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে গিয়ে তার ক্রিয়া হতে থাকে। এই গ্ল্যান্ডগুলিকে বলা হয় এন্ডোক্রিন, আর তার ঐ জাতীয় রসকে বলে হরমোন। কিন্তু কতকগুলি গ্ল্যান্ড আবার এমন আছে যা বহির্মুখী রসও আছে, আবার অন্তর্মুখী হরমোনও আছে। পুরুষের আর স্ত্রীলোকের দুই বিশিষ্ট প্রকারের মূল যৌন গ্ল্যান্ড এই উভয়মুখী জাতের। পুরুষের শরীরে এই বিশেষ ধরনের গ্ল্যান্ড আছে দুটি, তার নাম মুষ্ক। চলিত কথায় একে বলি বিচি। এর থেকে পুং বীজ উৎপাদিত হয় বলেই সম্ভবত এর ঐ নাম দেওয়া হয়েছে। পুরুষের এই বিশিষ্ট গ্ল্যান্ড দুটি ঢিলা চামড়ার এক থলির মধ্যে লিঙ্গের তলায় ঝুলতে থাকে। ওই থলিকে বলি অন্ডকোষ। মুষ্ক অর্থাৎ বিচির দুই ধরনের কাজ। একটি কাজ হলো বহির্মুখী রস বা শুক্র নিঃসরণ করা। শুক্রের মধ্যেই থাকে পুংবীজ অর্থাৎ ভবিষ্যৎ সন্তানের পিতৃকোষ। দুই দিকের দুটি শুক্রবাহী শিরা মুষ্ক থেকে বেরিয়ে উপরে উঠে মূত্রথলীর মুখের কাছ দিয়ে এসে শেষ পর্যন্ত লিঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করে। এই শিরাই হঠাৎ ফুলে উঠলে তাকে আমরা বলি একপ্সহিরা। এই শিরার মধ্যে আরো কয়েক প্রকার রস এসে শুক্রের সঙ্গে মিলে তাকে আরো পরিপুষ্ট করে। পুরুষের লিঙ্গ যখন উত্তেজিত ও দীর্ঘতর হয়ে স্ত্রীলোকের যোনিতে প্রবেশ করে, তখন উত্তেজনা চরম হয়ে অবশেষে আক্ষেপের দ্বারা ঐ শুক্রকে সে যোনির মধ্যে নিক্ষেপ করে। সেই শুক্রপাত থেকে সন্তান জম্মের প্রথম সূচনা হয়। তাহলে মুস্কের একটি স্থুল কাজ হলো এই; বহির্মুখী রসস্বরূপ শুক্রের সৃষ্টি করা। এই রসটি অনায়াসে চোখেই দেখা যায়। মুস্কের দ্বিতীয় অদৃশ্য এবং সূক্ষ্ম কাজটি হচ্ছে হরমোনের সৃষ্টি । ওর বিশিষ্ট প্রকার হরমোনের বৈজ্ঞানিক নাম টেস্টোস্টেরোন। যতক্ষণ পর্যন্ত বয়ঃসন্ধির কাল উপস্থিত হয়ে যৌবনে গমন না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই রসের আদৌ ক্ষরণ নেই। সুতরাং ততকাল পর্যন্ত এর ক্রিয়ার কোনো লক্ষণই নেই। এ হরমোনটি যার ক্ষরিত হতে শুরু হয়নি সে নিতান্ত বালক মাত্র, কোনো পুরুষোচিত লক্ষণের দ্বারা তাকে পুরুষ বলে প্রমাণ করা যায় না। এইন রস যখন থেকে ক্রিয়া তার মধ্যে পুরুষত্ব ফুটিয়ে তুলবে।

অর্থাৎ তার যৌন ইন্দ্রিয় অকস্মাৎ পরিপুষ্ট হয়ে উঠবে, ইন্দ্রিয়ের আশপাশে অনেক চুল গজাবে, মুখে দাড়িগোঁফ গজাবে, গলার স্বর ভারী হয়ে উঠবে, হাড়গুলি মোটা হবে, শরীরের গঠন হবে দৃঢ়তাব্যঞ্জক, চলবার ভঙ্গী হবে সতেজ ও দৃপ্ত, এবং কায়মনোবাক্য সে পুরুষোচিত ব্যবহার করতে থাকবে। সুতরাং এই আশ্চর্য রসটির কাজ হলো ছেলেকে সম্পূর্ণ পুরুষ করে তুলে। আশ্চর্যের কথা এই, যে ঠিক তখন থেকেই সে নতুন করে নারীর দিকে আকৃষ্ট হবে, নারীর সংসর্গ তার নতুন রকম ভাবে ভালো ভালো লাগবে, নারীর দেহের স্পর্শ পেলেই সে অজানিত পুলকে উৎফুল্ল হয়ে উঠবে। তাহলে এখন বোঝা যাচ্ছে এ সমস্তই ঐ অন্তর্মুখী হরমোন রসের কাজ। কিন্তু যদি যৌননোদগমের আগেই এই গ্ল্যান্ড দুটিকে কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়? তাহলে কেবল যে তাকে খোজা করা হবে তা নয়, তার পুরুষোচিত ওনো লক্ষণই আর হতে দেখা যাবে না। তার দাড়িওফোঁফ মোটে গজাবে না, কন্ঠস্বর হয়ে থাকবে নারীর মতো কোমল, যৌন ইন্দ্রিয় থাকবে বালকেরই মতো অপুষ্ট। ঐ সামান্য দুটি গ্ল্যান্ডের অভাবে স এজিবনে কখনো পুরুষত্বের সৌভাগ্য লাভ করতে পারবে না। সুতরাং এই গ্ল্যান্ডের অভ্যন্তরীন রস যে পুরুষ মানুষের যৌন অঙ্গাদির গঠন ও তার সমস্ত চরিত্রটাও উপর কতখানি প্রভাব বিস্তার করে এ কথা সহজেই অনুমান করা যায়। বস্তুত এর প্রভাব পুরুষের মনে যে যৌনক্ষুধা জাগায় তা পেটের ক্ষুধার চেয়েও তীব্র। পেটের ক্ষুদা যদিও বা দমন করা যায়, কিনুত একে দমন করা যায় না। স্ত্রীলোকের বেলাতে যে স্বতন্ত্র প্রকার দুটি যৌন গন্ড আছে নাম ডিম্বাশয়। এ দুটি থাকে ওদের তলপেটের গহরের মধ্যে, বাইরের থেকে টের পাওয়া সম্ভব নয়। এর গঠনও আলাদা, আর এর দুই ধরণের রসই সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির। এরও একটি নির্দিষ্ট বহির্মুখী রস আছে। সেই রসের মধ্যেই থাকে স্ত্রীলোকের ডিম্বকোষ বা মাতৃবীজ। আপনা থেকেই সেই রস নিয়মিত সময়ে ক্ষরিত হয়ে এক একটি ডিম্বকোষ সমেত বাইরে বেরিয়ে আসে। সেই ডিম্বকোষ থাকে তখ কাঁচা। বাইরের দিকে বেরিয়ে আসবার পরেই কাঁচা ডিম্বকোষকে ঘিরে একটি আবরণের সৃষ্টি হয়। সেই কাঁচা মাতৃবীজ যখন সঙ্গমের জন্য প্রস্তুত হয়ে পেকে উঠে, তখন তার অস্থায়ী আবরণটি ফেটে গিয়ে সেই পাকা ডিম্বকোষ মুক্ত অবস্থায় গতিশক্তিসম্পন্ন হয়ে শুক্রকীটের সঙ্গে সংযোগের প্রত্যাশায় জরায়ুর ভিতর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এছাড়া ডিম্বাশয় থেকে আরো তিন রকমের অভ্যন্তরীণ রস বা হরমোন তৈরি হয়। খাস ডিম্বাশয়ের ভিতরকার যে হরমোন, তার নাম ইসট্রিন। এই ইসট্রিনই নারীকে তার নারীত্ব প্রদান করে। এর প্রভাবে নারী হয় কোমলাঙ্গী, মধুরকন্ঠী, লজ্জাশীলা ও নারীসুলভ লক্ষণযুক্ত। জম্মাকাল থেকে বালিকা বয়স পর্যন্ত এ রসের মোটে সম্ভাবনাই হয় না, সুতরাং ততকাল পর্যন্ত এর কোনই ক্রিয়ালক্ষণ নেই। 

ততকাল পর্যন্ত ঋতুও হয় না, আর নারীত্বের কোনো বিশিষ্টতাও দেখা যায় না। যখন যৌবনোদগমের সময় হয়, তখন  থেকে এই রস ক্ষরিত হয়ে আপন ক্রিয়া করতে শুরু করে। এর ফলে তখন থেকে ঋতুও হতে থাকে এবং নারীত্বের সকল রকম লক্ষণগুলিও ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে। এর ক্রিয়া যে তখন থেকে সারা জীবনের জন্য স্থায়ী হবে তাও নয়। মেয়েদের পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের মধ্যে এর ক্ষরণ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে মেয়েদের ঋতু হওয়াও থেমে যায়, নারীত্বের লক্ষণগুলিও একে একে লোপ পায়। নারী যে পুরুষকে আকর্ষণ করতে পারে, তা এই রসেরই গুণে। এর ক্ষরণের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের চালচলন হাবভাব সম্পূর্ণ বদলে যায় এবং পুরুষ দেখলেই তারা চঞ্চল হয়ে ওঠে। বাইরে প্রকাশ না করলেও অন্তরে তখন তারা পুরুষের সঙ্গ কামনা করে, পুরুষকে নানাভাবে আকর্ষণ করবার জন্য অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠে। অস্পষ্ট ভাবে তাদের মনে যৌন চেতনা জাগতে থাকে, অকারণে পুরুষ মাত্রকেই যেন তাদের পছন্দ হতে লাগে। কোনো মেয়ে নির্বোধ হলেও এ অবস্থায় পুরুষের পক্ষে তাকে ভুলিয়ে যৌনমিলনে সম্মত করানো বিশেষ কঠিন নয়, কারণ সে তখন এই প্রকৃতিদত্ত ইসট্রিনের প্রভাবে ওরই জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠেছে। সুতরাং এই সময়টিতে অনুঢ়া মেয়েদের বিশেষ সাবধানে রাখা দরকার। ডিম্বাশয়ের সম্পর্কে আরো দুই রকমের আভ্যন্তরীণ রস আছে। উপরে আমরা যে ডিম্বাকোষ অবরণটির কথা উল্লেখ করেছি, ঐ আবরণ বস্তু থেকেই সেই দুই রসের সৃষ্টি হয়। তার মধ্যে একটি জম্মায় ওর অচ্ছিদ্র অবস্থাতে, আর একটি দেখা দেয় আবরণটি ফেটে যাবার পরে। প্রথমটি ঋতুস্রাব প্রভৃতি সম্পর্কে ইসট্রিনকে কিছু সাহায্য করে। আর দ্বিতীয়টি ইসট্রিনের ক্রিয়াশীল। যখন পুংবীজ এসে স্ত্রীবীজের সঙ্গে মিলিত হয়ে ভ্রূণ উৎপন্ন করেছে, তখন থেকে হয় এই ক্রিয়া শুরু। এর নাম প্রোজেস্টিন। এই প্রোজেস্টিন প্রধান হয়ে উঠে তখন ঋতুস্রাবটিকে বন্ধ করে দেয়, সন্তান পুষ্টির সহায়তা করে, জরায়ুর কলেবর বৃদ্ধি ও মাতৃস্তনের পুষ্টি ঘটায়, আর সন্তান ভুমিষ্ট হবার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের স্তনে দুধের স্রোত ও তার হৃদয়ে বাৎসল্যের স্রোত প্রবাহিত করে দেয়। তখন আর ইসট্রিনের প্রভাব নেই, এসে গেছে প্রজেস্টিনের প্রভাব। নারী তখন আর যৌনমিলএর সেই প্রিয়া নেই, সে হয়ে গেছে সন্তানের জননী। এমন অদ্ভুত রূপান্তরের সমস্তই ঘটেছে অভ্যন্তরীণ রসের কারণে। অভ্যন্তরীণ রসের বদলের দ্বারা অনেক অঘটন ঘাটানোও সম্বব হয়েছে, অর্থাৎ পুরুষকে নারী আর নারীকে পুরুষে পরিণত করা গেছে। পরীক্ষার জন্য কেউ কেউ পুরুষ-জন্তুর দেহে স্ত্রীগন্ড আর স্ত্রী-জন্তুর দেহে পুরুষ-গন্ড জুড়ে দিয়েছিলেন। তার ফলে দেখা গেল যে স্ত্রী-গন্ডযুক্ত পুরুষেরা তখন আসল পুরুষদের দেখে নারীর মতো ব্যবহার করতে লাগলো। এদিকে পুরুষ – গন্ডযুক্ত নারীরা অন্য নারীদের সঙ্গে পুরুষোচিত ব্যবহারই করতে লাগলো। এই সমস্ত অভ্যন্তরীণ রসের ওলট-পালট ঘটলে যে মানুষের চরিত্রও উলটে-পালটে যায়, এর উদাহরণ আমরা নিজেদের মধ্যেও অনেক দেখতে পাই। সংসারে পুরুষের মতো নারী আর নারীর মতো পুরুষের কোনো অভাব নেই। 


যাই হোক অস্বাভাবিকের কথা বাদ দিয়ে এখন আমরা স্বাভাবিক বৈচিত্র্য নিয়েই আলোচনা করছি। আমাদের ব্যক্তিগত চরিত্র আর যৌন কামনার জাগরণ যে অনেকটা অভ্যন্তরীণ রসের উপরেই নির্ভর করছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু এটুকু বললেই যে সব কথা বলা হলো তা নয়। ভিতরকার প্রভাব ছাড়াও বাইরের আবেষ্টনের অনেক প্রভাব আমাদের উপর ক্রিয়া করে। তার মধ্যে একটি হলো বাপ মায়ের প্রভাব, আর একটি স্থানীয় রীতি ও বংশানুক্রমিক সংস্কারের প্রভাব। আমরা গোড়ার যেমন আবেষ্টনের মধ্যে মানুষ হয়েছি তার প্রভাব বয়স কালেও আমাদের মধ্যে থেকে যায়। ছেলেবেলায় যেমন ভাবে পাঁচজনকে চলতে দেখে এসেছি সেই ভাবেই আমরা কতকটা চালিত হই। যৌন জীবনও আমাদের অজানিত রূপে সেই ভাবে চালিত হতে শুরু করে। আর কে রকমের প্রভাব আছে, সেটা হলো শিক্ষার। সমুচিত শিক্ষার দ্বারা মানুষ তার বদ্ধমূল সংস্কারকেও দূর করতে পারে, উগ্র কামনা এবং তীব্র বিতৃষ্ণাকেও মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। আবার খারাপ শিক্ষার উৎকৃষ্ট স্বভাবের মানুষও সর্ব \নাশের পথে চালিত হয়। ভুল শিক্ষায় বিশেষ কতকগুলো বাঁকা ধারণা জম্মায়। বাঁকাচোরা ও বিকৃত ধারণা থেকে জম্মায় জটিল রকমের চরিত্র। আমাদের যৌন সম্বন্ধীয় আচরণকে তাতেই অস্বাভাবিক করে দেয়। অবশ্য বাঁকাচোরা ধারণাকে যদি সোজা রকমের শিক্ষা দিয়ে সারিয়ে নিতে পারি, তাহলে যৌন সম্বন্ধে বাঁকা পথে চালিয়ে নিয়ে যাবার ভূতটা ঘাড় থেকে নেমে গিয়ে আপনিই সোজা হয়ে যায়। কিন্তু তাতে ভুল কিংবা বিকৃত শিক্ষার দ্বারা গোরাতেই কোনো গন্ডগোল না ঘটে, তেমন ভাবের জ্ঞানলাভের ব্যবস্থা আমাদের গোরা থেকেই করা উচিত। আমরা এখনকার যুক্তিবাদী অন্ধসংস্কার মুক্ত মানুষ। এটুকু আমাদের জানা উচিত যে সুশিক্ষা না দিলেই কুশিক্ষা এসে তরুণ বয়সের সন্ধানী মনটিকে দখল করে বসবে এবং কামনাকে অনিষ্টের পথে জাগিয়ে তুলে সেইদিক দিয়ে উত্তেজিত করতে থাকবে। অভ্যন্তরীণ রসগুলি তখন আপনার নির্দিষ্ট কাজ করতে শুরু করেছে, অথচ তার সেই যৌন ক্ষুধাবোধকে সংযত করবার মতো কোনো সুশিক্ষাই নেই। এ অবস্থায় পদস্খলন হওয়া একটুও অসম্ভব নয়। আমরা জানিত একটি মেয়ের দুর্গতি ইতিহাস এইখানে উদাহরণ স্বরূপ বলি। মেয়েটি পড়ছিল কলেজে। দূর সম্পর্কে কোনো দরিদ্র আত্মীয় যুবক বাড়িতে থেকে তাকে পড়াতো। কলেযে কোনো সহপাঠিনীর সঙ্গে মেয়েটির খুব হৃদ্যতা ছিল। সে দেখল প্রত্যহ টিফিনের সময় ঐ সহপাঠিনী কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে অত্যন্ত গোপনে কি সব আলোচনা করে। একদিন তাই নিয়ে ঔৎসুক্য প্রকাশ করাতে সহপাঠিনী একে সেই দলের অন্তর্ভুক্ত করে নিল। প্রত্যহই সেখানে আলোচনা হতো কোন মেয়েটি তার কোন যুবক বন্ধুর সঙ্গে কি কি অ্যাডভেঞ্চার করেছে, আর তার থেকে কেমন সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে।

প্রত্যেকেরই তরফে অনেক কথা বল্বার থাকতো যা শুনলে শরীরের রক্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, আর শ্রোতারও তেমনি সব অ্যাডভেঞ্চার করতে লোভ হয়। ঐ নতুন মেয়েটিকেও সকলে নানা কথা জিজ্ঞাসা করতো, কিন্তু ওর কিছুই অভিজ্ঞতা নেই। ওর তখন বাড়ির সেই আত্মীয় যুবকটির দিকে নজর গেল। ভাবলো এই তো হাতের কাছেই রয়েছে মিলনের উপযুক্ত পাত্র। তখন থেকে নানা উপায়ে ও সেই যুবককে প্রলুদ্ধ করতে লাগলো। তাতেও বিশেষ কাজ হয় না দেখে তাকে হাতে হাতে চিঠি দিতে শুরু করলো। যুবক অচিরেই উন্মত্ত হয়ে উঠলো। ক্রমে যৌন মিলন শুরু হয়ে গেল, আর মেয়েটি সগৌরবে সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঙ্গিনীদের কাছে ব্যক্ত করতে লাগলো। কিন্তু কিছুকাল পরে তার গর্ভলক্ষণ প্রকাশ পেলো। মেয়েটির বাপ মা সব কথা জানতে পেরে যুবককে ধরে পীড়ন করতে লাগলেন। সে তখন মেয়েটির লেখা সমস্ত চিঠিগুলি এনে দেখালো। শাস্ত্রসম্মত ভাবে ঐ জ্ঞাতি যুবকের সঙ্গে মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কোনো উপায়ন্তর না থাকায় জোর করে তারা দুজনের বিয়ে দিয়ে দিলেন। কিন্তু এমন ধরনের বিয়েতে কি কেউ শেষ পর্যন্ত সুখী হয়? সে যাই হোক, কিন্তু এখানেই ওর দুর্গতির শেষ হলো না। কিছুদিন পরে জানা গেল যুবকটির সিফিলিস ছিল। ঐ নির্বোধ মেয়েটিকে বিয়ের কিছুকাল পরেই একসঙ্গে গর্ভ ও সিফিলিস নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হলো। এখন মনে করা যাক, ওই মেয়েটির যদি শিক্ষা থাকতো, কিসে কি হয় তা যদি আগের থেকে ভালো ভাবে জানা থাকতো, তাহলে কি আর এমন দুর্গতি হতো? হয়তো তার কামনাও জাগতো, অ্যাডভাঞ্চার করবার লোভও জাগতো, কিন্তু সেটাকে নিশ্চয়ই সে সামলে নিতে পারতো। এই দুর্গতির জন্য তাকেই সম্পূর্ণ রূপে দ্বায়ী করা যায় না। সুশিক্ষার অভাবই এর জন্য দ্বায়ী। প্রকৃতির প্রভাব সময়মতো তার নিজের কাজ করবে বটে, কিন্তু শিক্ষার প্রভাবই তাকে ঠিক পথে চালিত করবে।
Share on Google Plus

About Unknown

0 comments:

Post a Comment

Thanks for your comments.